সাহিত্য ও নাট্যচর্চায় নেত্রকোণা

0
18

এমদাদ খান:

গদ্যে কথা বলে দেশের অগনন মানুষ। একের সাথে অন্যের কথা হয় গদ্যে। ভাবের আদান প্রদান হয় গদ্যে। গদ্য বুঝতে পারে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। গদ্য ছাড়া মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। পদ্য বুঝে দেশের একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষ। যারা শিক্ষিত, প্রাজ্ঞ, কাব্যামোদী ও আবেগপ্রবণ। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের যা কিছু সৃষ্টি সবই হয়েছে পদ্যে। হয়েছে গানে। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে আধুনিককালে বিকশিত হতে লাগলো গদ্য। গদ্যে রচিত হতে লাগলো নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প। গদ্যকে অবলম্বন করে যাত্রা শুরু হলো সংবাদপত্রের। এমনকি ছন্দকে বিদায় দিয়ে কবিতাও লেখা হতে লাগলো গদ্যে। চারিদিকে এখন গদ্যের জয়জয়কার। ‘আধুনিক জীবন গদ্য শাসিত। বর্তমানের প্রভু হচ্ছে গদ্য।’
সাহিত্যে গদ্য আসার সাথে সাথে অভিনয়কলায় সঞ্চারিত হলো নতুন গতি। এখানে আমরা যাত্রা কিংবা পালাগান নিয়ে আলোচনা করব না। এখানে আমরা আলোচনা করব আধুনিক কালে যাকে বলে নাটক-সেই নাটক নিয়ে। এদেশে নাটকের বিকাশ ঘটেছে পাশ্চাত্য শিল্পরীতি ও দেশীয় লোকজ রীতির সংমিশ্রণে ঊনিশ শতকে। আধুনিক বাংলা নাটক বিকাশে একজন বিদেশীর অবদান অপরিসীম। তার দেশ রাশিয়া। নাম গেরাসিম লেবেদেরু। ১৭৯৫ সালে তিনিই কলকাতায় প্রথম মঞ্চস্থ করেন ‘ডিসগাইস’ নাটকের বাংলা অনুবাদ। তাকে অনুসরণ করে তারপর এদেশে গড়ে উঠে মঞ্চ। লিখিত ও অভিনীত হতে থাকে একের পর এক নাটক। বাংলা মৌলিক নাটক রচিত হয় আরো ৫০ বছর পরে ১৮৫২ সালে। নাম ভদ্রার্জুন। নাট্যকার তারাচরণ শিকদার। নাটকটি কমেডি অর্থাৎ মিলনাত্বক। এ বছরই লেখা হয় ট্রাজেডি নাটক ‘কীর্তিবিলাস’। নাট্যকার যুগেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত। ভদ্রার্জুন নাটকের কাহিনী নেয়া হয়েছিল মহাভারত থেকে আর কীর্তিবিলাস নাটকের কাহিনী নেয়া হয়েছিল ফরাসী ভাষার একটা নাটক থেকে। এ সময়েই নাট্যকার হরেশ চন্দ্র ঘোষ ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিস অবলম্বনে লেখেন ‘ভানুমতি চিত্তবিলাস’ নাটক। রোমিও জুলিয়েট অবলম্বনে লেখেন ‘চারুমুখ চিত্তহারা’ নাটক। এ সময়ে রামনারায়ণ তর্করতœ লিখেছিলেন বেশ কটা নাটক। তার শ্রেষ্ঠ নাটকটির নাম কুলীনকুল সর্বস্ব। এ সময় আরো ক’জন নাট্যকার সফল নাটক লিখেছিলেন। তার মধ্যে উমেশ চন্দ্র মিত্র, নন্দ কুমার রায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ উল্লেখযোগ্য। কালীপ্রসন্ন ছিলেন সে সময়ের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। তার শ্রেষ্ঠ নাটক সাবিত্রী সত্যবান।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আসেন অমর নাট্যকার মুধসুদন দত্ত। কবিতার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য, অসাধারণ। কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে তিনি সবাইকে চমকে দিলেন। তার ছিল অসাধারণ প্রতিভা। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হলো তার প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’। শর্মিষ্ঠা বাংলাভাষার প্রথম বিশুদ্ধ আধুনিক নাটক। কাহিনী বিন্যাস, অঙ্ক ও দৃশ্যসজ্জা, ভাষা, নাটকীয়তা সব মিলে এটি বাংলা ভাষার প্রথম খাঁটি নাটক। মধুসূদন শর্মিষ্ঠার কাহিনী নিয়েছেন মহাভারত থেকে। নাটকটি মিলনাত্বক। তিনি পুরাতন কালের কাহিনীকে পরিবেশন করেছেন নতুন কালের উপযোগী করে। ১৮৬০ সালে তিনি বের করেন পদ্মাবতী নাটক। এর কাহিনী নেন তিনি গ্রীক উপকথা থেকে। তার শ্রেষ্ঠ নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে। এ নাটকটি ছিল মর্মভেদী, ট্রাজেডী। ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তার শেষ নাটক মায়াকানন। মধুসূদনের সময়কালের প্রতিভাবান আর এক নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র। তিনি লিখেছিলেন অনেকগুলো নাটক। তার প্রথম নাটক নীল দর্পন প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। নাটকটি প্রকাশের সাথে সাথে এটি সমাজে ও সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি একটি বিপ্লবী রচনা, একটি মহৎ সৃষ্টি। তার উল্লেখযোগ্য অন্যান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে নবীন তপস্বিনী, সধবার একাদশী, বিয়ে পাগলা বুড়ো, লীলাবতী, কমলে কামিনী প্রভৃতি।
দীনবন্ধুর পরে আসেন আর এক নাট্যপ্রতিভা মনোমোহন বসু। তিনি লেখেন রামের অধিবাস ও বনবাস, প্রণয়পরীক্ষা, সতী, হরিশ চন্দ্র প্রভৃতি নাটক। এ সময়ে আসেন আরো অনেক নাট্যকার। তাদের মধ্যে মীর মোশাররফ হোসেন লেখেন বসন্ত কুমারী, জমিদার দর্পন। মণিমোহন সরকার লেখেন মহাশ্বেতা। হরিশ চন্দ্র মিত্র লেখেন ম্যাও ধরবেকে। ঊনিশ শতকের শেষাংশে মঞ্চ আলোকিত করেছিলেন অনেক নাট্যকার। তাদের মধ্যে অন্যতম ক’জন হচ্ছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, অমৃতলাল বসু ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। গিরিশ চন্দ্র ছিলেন নট এবং নাট্যকার। তার নাটকের সংখ্যা পঁচাত্তর। বাংলা ভাষায় এতো নাটক আর কেউ লেখেননি। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে আনন্দরহো, চৈতন্য লীলা, প্রফুল- হার নিধি, সিরাজদ্দৌলা, মীর কাশিম, ছত্রপত্রি শিবাজী প্রভৃতি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের মধ্যে একজন। কল্কি অবতার, প্রতাপ সিংহ, দুর্গা দাস, নূরজাহান, শাহ্জাহান, মেবার পতন, চন্দ্রগুপ্ত প্রভৃতি তার উল্লেখযোগ্য নাটক। ক্ষীরোদ প্রসাদ লিখেছেন চল্লিশটির মতো নাটক। তার দুটি ঐতিহাসিক নাটকের নাম প্রতাপ আদিত্য ও আলমগীর। তিনি বিশেষ জনপ্রিয় আলী বাবা নাটকের জন্য।
রবীন্দ্রনাথ কাব্যনাট্য লিখেছেন, গীতিনাট্য লিখেছেন, লিখেছেন নাটক ও প্রহসন। লিখেছেন নৃতা/নাট্য। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে বিসর্জন, মালিনী, চিত্রাঙ্গদা, অচলায়তন, রক্ত করবী, শেষরক্ষা, তাসের ঘর, কালের যাত্রা, বসন্ত, চিরকুমার সভা প্রভৃতি। তার নাটকের অধিকাংশই তিনি লিখেছেন বিশ শতকের প্রথম ভাগে। বিশ শতকের আরো দু’জন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন মন্মথ রায় এবং বিজন ভট্টাচার্য। মন্মথ রায়ের শ্রেষ্ঠ নাটকের নাম কারাগার আর বিজন ভট্টাচার্যের নাটকের নাম নবান্ন। ষাটের দশকে বুদ্ধদেব বসু লেখেন অসাধারণ একটি কাব্য নাটক। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তপস্বী ও তরঙ্গিনী, কলকাতার ইলেক্ট্রা। নাটক দুটি কাব্যগুণে অসামান্য। ঊনিশ ও বিশ শতকে বাংলা ভাষায় অসামান্য নাটক রচিত হয়েছে তার মধ্যে মধুসূধন, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও বুদ্ধদেব বসুর নাটকই শিল্পগুণে শ্রেষ্ঠ।
ষাটের দশকে মুনীর চৌধুরী লেখেন কবর ও রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক। দুটি নাটকই শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে যে ক’জন নাট্যকার শিল্পগুণে সমৃদ্ধ নাটক লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সেলিম আল দীন। তার নাটকের মধ্যে সাতশো সাতাত্তর, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, ছায়াশিকারী উল্লেখযোগ্য।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতায় গড়ে উঠেছিল অনেকগুলো নাট্যগোষ্ঠি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ওল্ড জেল হাউজ (১৭৫৩), দি নিউ পেন হাউজ বা ক্যালকাটা থিয়েটার (১৭৭৫), হোয়েলার প্রেম থিয়েটার (১৭৯৭), চৌরঙ্গী থিয়েটার (১৮১৩) ও দমদম থিয়েটার (১৮১৭)।
স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক নাটকের বিকাশ ও বিস্তারে নেত্রকোণার নাট্যকারদের অবদান অপরিসীম। হুমায়ূন আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। সমকালীন বাংলা নাট্য অঙ্গনের তিনি প্রবাদ পুরুষ। তার জন্ম নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার অন্তর্গত কুতুবপুর গ্রামে। নেত্রকোণাবাসীর তিনি অহংকার। টিভিতে প্রচারিত হয়েছে তার বেশ কটি ধারাবাহিক নাটক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এই সব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, ঢাকায় থাকি, বহুব্রীহি, অয়োময়, নক্ষত্রের রাত্র প্রভৃতি। তিনি একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতাও। তার নিজের লেখা কাহিনী নিয়ে নির্মাণ করেছেন বেশ ক’টি চলচ্চিত্র। তার মধ্যে শঙ্খনীল কারাগার, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী ও চন্দ্রকথা অন্যতম। শিল্পগুণ সমৃদ্ধ নাটক ও ছবি নির্মাণ করে তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারসহ একাধিক পুরষ্কার।
হুমায়ূন আহমেদ এর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল মূলতঃ একজন সায়েন্স ফিকশন লেখক। শিশুদের উপযোগী করে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন। তার দীপু নম্বর টু একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। এর কাহিনী নিয়ে তৈরী হয়েছে একটি পরিচ্ছন্ন চলচ্চিত্র। পূর্বধলা উপজেলার হাফানিয়া গ্রামের মাহবুব তালুকদার একজন সফল নাট্যকার। তার লেখা প্রথম নাটক জলছবি ১৯৫৮ সালে বেতারে প্রচারিত হয়। ১৯৬৫ সালে প্রচারিত হয় তার ঘোড়ার গাড়ি। ১৯৬৭ সালে বিটিভিতে প্রথম প্রচারিত হয় তার নাটক হারানো প্রাপ্তি। বিটিভিতে প্রচারিত তার ধারাবাহিক নাটক চেনামুখ ও ভগ্নাংশ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
নেত্রকোণার আর এক খ্যাতিমান টিভি নাট্যকার হলেন ফকির আশরাফ। তার জন্ম বারহাট্টার চল্লিশ কাহনিয়া গ্রামে। ১৯৯৪-১৯৯৫ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হয় তার ধারাবাহিক নাটক ‘তথাপি’ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। নেত্রকোণার আর এক উল্লেখযোগ্য নাট্যকার হলেন প্রকৃতি রঞ্জন চন্দ (পিআর চন্দ)। তিনি নেত্রকোণা সদর থানার গাবরাগাতি গ্রামের সন্তান। কাজী নজরুল ইসলাম এর গল্প অবলম্বনে লেখা তার জিনের বাদশা নাটকটি ময়মনসিংহের টাউন হলে মঞ্চস্থ হয়েছিল। শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্প অবলম্বনে লেখা বিলাসী এবং হাসনরাজা নাটকটি সিলেট বেতারে প্রচারিত হয়েছিল। সারদা পুলিশ একাডেমিতে মঞ্চস্থ হয়েছিল তার নাটক পুলিশ ও মানুষ। তার লেখা মেন্দিপাতাও একটি প্রশংসিত নাটক।
দুর্গাপুরের অধ্যাপক শহীদ খানের লেখা ফুলবাড়িয়ার মানুষ। মুসলেম উদ্দিন এর লেখা হোগলার নূরী আল্লারাখা ও কমলার চোখে জল ময়মনসিংহের টাউন হলে মঞ্চস্থ হয়েছে। মোহনগঞ্জের রইস মনোরম এর লেখা ঘোলাজলে বেহুলার লাশ ও শেকড় বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। দুটি নাটকই মঞ্চ সফল। মনোয়ার সুলতান রচিত বিরামপুরের ফুলবানু একটি দর্শক নন্দিত নাটক।নাট্যকলা চর্চা ও বিকাশে নেত্রকোণার স্থানীয় জমিদারদের ভূমিকা প্রশংসার দাবী রাখে। জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন নাট্যামোদী ও সংস্কৃতি প্রেমী। পূজা-পার্বনে জমিদারদের বাড়িতে আয়োজন করা হতো সঙ্গীত, যাত্রা, নাটক প্রভৃতি নানা অনুষ্ঠানের। সুসং জমিদার পরিবারের অনেক তরুণ নাট্যাভিনয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। সেখানকার স্থায়ী মঞ্চে যারা নিয়মিত অভিনয় করতেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিনেতারা হলেন হিমাংশু সাহা, শিশির সরকার, মাখনলাল সাহা, জ্যোতি ভট্টাচার্য, পলিন ভট্টাচার্য ও কাজল চক্রবর্তী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here