আত্মহত্যা ও অভিভাবকদের অসচেতনতা

0
14

এখন যুগটা সম্পূর্ণ প্রযুক্তির যুগ। হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী। তাদের চিন্তা-চেতনা অনেক সমুন্নত। তাদের শাসন নয়, তাদের জন্য প্রয়োজন মমতা, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সহযোগীতা।

ইলা মুৎসুদ্দি

বছর দুয়েকের মধ্যে টিনএজদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অধিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন বৃদ্ধি পেয়েছে সেটা নিয়ে আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, তাহলে দেখা যাবে — কোভিড পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে একধরণের হতাশা, বিষণ্ণতা বোধ গ্রাস করেছে।
কোভিডের সময়ে দেখা গেছে দিনের পর দিন বাসায় একধরণের বন্দী অবস্থায় থাকা, পরিবারের সঙ্গ না পাওয়া, বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশতে না পারায় একাকীত্ববোধের কারণে অনেকেই বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। বর্তমানে বছর দুয়েকের মধ্যে আবারও আত্মহত্যার প্রবণতা খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ হিসেবে যদি বলি অভিভারকদের অসচেতনতা কিংবা অজ্ঞতাই এজন্য দায়ী। প্রশ্ন আসতে পারে কিরকম দায়ী?
দেখা যায় একজন শিক্ষার্থী এস.এস.সি এবং এইচএসসি পাশ করার পরে যখন টার্গেট অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেল না, তখন পরিবারের সদস্যরা উক্ত শিক্ষার্থীর সাথে খারাপ আচরণ করতে শুরু করেন। অনেক মা-বাবা তো সন্তানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। আবার অনেকেই বাইরের লোকের সামনে সন্তানকে অপমান করেন। যা একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে মেনে নেয়া খুবই কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যদের এহেন আচরণে তার মধ্যে হতাশাবোধ এবং বিষন্নতা চরম আকার ধারণ করে। ফলে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। মা-বাবার বোঝা উচিত তাদের এখনো বাস্তবতা জ্ঞান আসেনি।
অভিভাবকদের একটাই টার্গেট যে করেই হোক সন্তানকে জিপিএ ৫ পেতেই হবে। তারপর মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং টার্গেট করে কোচিং এবং প্রাইভেট টিউটরের পিছনে দৌড়াতেই থাকেন। এভাবে দৌড়ালে দিনশেষে ফলাফল হয় শূন্য।
বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে বলতে শুনি ওরা বাসায় গিয়ে বই পড়ার সময় ই পায় না। কারণ সারাদিন ৪/৫টা কোচিং, বাসায় প্রাইভেট টিউটর এসব করতে করতেই দিন শেষ। কোচিংয়ের টিচাররা গাইড বই দেখে দেখে যা শেখায় তাই তারা শিখে। পুরো বই পড়ে নিজের থেকে কিছু শিখবে সেই সুযোগ তারা পায়না। এভাবে সন্তানদের যথাযথ শিক্ষা দেয়া হয় না। ঠিক আছে, আমি কোচিংয়ে দিব, প্রাইভেট টিউটর অবশ্যই দিব। তার আগে সন্তানের মেধা যাচাই করে দেখতে হবে সে কোন বিষয়ে দুর্বল, কোন বিষয়টি নিজে নিজে পড়তে পারছে। অহেতুক একগাদা কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে ওদেরকে যন্ত্রমানবের মত পরিচালিত করলে সেই সন্তানের মধ্যে বেসিক জ্ঞান হবে কিভাবে? তাকে সুযোগ দিতে হবে। বছর শেষে শুরু হয়ে যায় অভিভাবকদের দৌরাত্ম্য। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী ক্লাসের জন্য কোচিং এ এডভান্স সিট বুকিং দিয়ে এসেছে। সন্তানকে একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি । কারণ একটাই, আমরা অভিভাবক — আমরা যা বলব সেটাই হবে শেষ কথা। কারণ অভিভাবকরা তো সবসময় সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। এভাবে সন্তানের মঙ্গল করতে গিয়ে জোর করে পড়ার বোঝা চাপিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত যে অমঙ্গল করে যাচ্ছি সেটা বোঝার ক্ষমতা অভিভাবকদের কি আছে? যদি থাকতো তাহলে আজ বুয়েটে কিংবা মেডিকেলে চান্স পায়নি বলে সন্তানকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হতো না। আমার খুবই অবাক লেগেছে একটা বিষয়ে —অনেক অভিভাবককে দেখেছি, তাদের ছেলে-মেয়েরা কত ভাল গান করে, নাচ করে। শুধুমাত্র টার্গেট ফিলাপ মানে পড়ার জন্য নাচ, গান সব বাদ করে দিয়েছে। যে সন্তান সারাক্ষণ শুধুমাত্র পড়া নিয়েই অনিচ্ছাকৃতভাবে বসে থাকে, তার কাছে বিনোদন বলতে কিছুই থাকে না সেই পড়ার রেজাল্ট ভালো হবে কিভাবে? সে টিভি দেখতে পারে না, গান করতে পারে না, শুনতে পারে না। একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে অবুঝ মনের সন্তানেরা আত্মহননের দিকে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ আমরাই এগিয়ে দিই। কোনদিন জিজ্ঞাসা করেছেন, আজ কী খেতে ইচ্ছে করছে? কোথাও বেড়াতে যাবি? এসবে আমরা অভ্যস্ত নই। আমরা শুধু বলি ভালো করে পড়ালেখা করো। তোমাকে অমুক হতে হবে, তমুক হতে হবে। যাতে আমাদের গর্বে বুক ফলে উঠে, আমরা যেন বলতে পারি আমার ছেলে বা মেয়ে মেডিকেলে পড়ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
একজন অভিভাবককে দেখেছি মেয়ে বুয়েটেও আসছে, মেডিকেলেও চান্স পেয়েছে। মেয়ের ইচ্ছা বুয়েট পড়ার অথচ মা-বাবার ইচ্ছা মেয়ে মেডিকেলে পড়বে। মেয়ের ইচ্ছার কোন মূল্য না দিয়ে মেয়েকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছে। যেখানে নিজে খুশীমনে পড়াটাকে গ্রহণ করতে পারছে না সেখানে ও কিভাবে ভালোভাবে পড়বে। আরো আছে, আমার (অভিভাবক) বয়স ৫০ বছর। আমি যখন সন্তানদের সাথে কথা বলি আশা করি যে তারাও আমার মতন করে কথা বলবে, আমার মত করে সবকিছু বুঝবে। একবারও ভাবি না তাদের বয়স কম, তারা আমার মতন করে কখনোই বুঝবে না। বরঞ্চ বেশি বুঝাতে গেলে তারা খুবই বিরক্ত বোধ করবে।
অভিভাবকদের আরো বড় সমস্যা হচ্ছে তারা মনে করে সন্তানদের সবসময় কড়া শাসনে রাখতে হবে। নাহলে সন্তান বখে যাবে। এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। এখন সেই আগেকার যুগ নেই মা-বাবা, দাদা-দাদী যা বলবে সন্তানেরা তাই শুনবে। এখন যুগটা সম্পূর্ণ প্রযুক্তির যুগ। হাতের মুঠোয় পুরো পৃথিবী। তাদের চিন্তা-চেতনা অনেক সমুন্নত। তাদের শাসন নয়, তাদের জন্য প্রয়োজন মমতা, ভালোবাসা আর বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও সহযোগীতা। সন্তানদের কখনো গায়ে হাত তোলা উচিত নয়। এতে তারা আরো বেশি বেপরোয়া উয়ে উঠে। যা অভিভাবকরা বুঝতে পারেন না। যখন বুঝতে পারেন তখন অনেক দেরী হয়ে যায়।
অনেক অভিভাবক সন্তানদের বাইরের লোকের সামনে অপমান, তিরষ্কার করেন। এটা মোটেও উচিত নয়। এতে করে সন্তানদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। তাদের ধারণা মা-বাবা তাদের ভালোবাসে না। ফলশ্রুতিতে মা-বাবার প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা জাগে। যেহেতু নিজেরা বাড়ীতে অসম্মানিত হয়, তাই তারা বাইরের মানুষকেও সম্মান করতে চায় না।
সন্তানদের চাওয়া পাওয়ার দিকে নজর দিন। তাদের পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করুন। খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের মেধাকে বিকশিত করার সুযোগ দিন। সারাক্ষণ পড়া পড়া করবেন না। একঘন্টা টিভি দেখতে দিন। সন্তানরা যাতে মনের আনন্দে পড়তে পারে সেই খেয়াল রাখুন। ওদের মতামতকে গুরুত্ব দিন। সন্তানদের আমরা যদি পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের মনের পরিচর্যা করার ব্যবস্থা করে দিই, তাদের উপর অহেতুক নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা না করি তাহলে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস পারে বলে আমার বিশ্বাস। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করুন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে যে বিষয় নিয়ে পড়তে আগ্রহী সেই বিষয়ে পড়তে তাদের উৎসাহিত করুন। দেখবেন এতে করে সন্তানেরাও ভালো থাকবে, তারা কখনো বিপথগামী হবে না। মা-বাবার সম্মান রক্ষার্থে তারাও সর্বদা সচেষ্ট থাকবে।

……………………………………..
পরিচিতি: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here